Wednesday, 28 October 2015

দ্বিতীয় পর্ব : কাঁথার উৎস ও ইতিহাস ( দ্বিতীয় খন্ড )

     বাংলার  কাঁথা শিল্প এক সুপ্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সুচিশিল্পের যোগ আদিমকাল থেকেই লক্ষ করা যায়। এই শিল্প প্রাচীন ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শিল্প হয়ে উঠেছিল।  

    কাঁথার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋক্ বেদ ও উপনিষদ তথা বৌদ্ধ পালি সাহিত্যে। মহাভারতের শান্তি পর্বে উল্লিখিত আছে - '' জীর্ণা কন্থা ততঃ কিম় " (শান্তি ৪। ৫। ১৯) । চন্দ্রাবতীর রামায়নে সীতার দক্ষতা বা গুন প্রসঙ্গে কন্থার কাজের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এমনকি কবি ভারতচন্দ্রের লেখনীতেও কাঁথার উল্লেখ রয়েছে। শিবের উপস্থাপনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন - "ঝুলি কাঁথা বাঘ ছাল সাপ সিদ্ধি লাড্ডু "। মেগাস্থিনিসের '' ভারত বৃত্তান্ত " এবং পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে কাঁথা উল্লেখ লক্ষ করা যায়। এ ছাড়াও আরও একাধিক বইতে কাঁথার উল্লেখ পাওয়া যায়। 


     বহু প্রাচীনকাল  থেকে জীর্ণ বস্ত্রখন্ডে তৈরী কাঁথার ব্যবহার শুরু হলেও কাঁথার গায়ে বিচিত্র নকশা খচিত করার রেওয়াজ কবে প্রচলিত হয় তা সঠিকভাবে বলা যায় না। কাঁথার সংগ্রহ রয়েছে বিভিন্ন সংগ্রহশালায়। এইসব কাঁথার বয়স খুব বেশি পুরোনো নয়। স্টেলা আরিখের রচনায় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের  কাঁথার সন্ধান পাওয়া যায় ( Marg III, No. 2, P. 20 )। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রভাস সেন কাঁথার প্রাচীনতা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা হল : - 

    The tradition of kantha embroidery is very old. It is mentioned in the definitive Sanskrit grammar written by Panini  around the six century B.C. and also in the epic Ramayana of Valmiki about two centuries later. The earliest mention of kanthas in Bengali literature is found in the Charyapadas- the earliest known in as old form of Bengali that prevailed from the 8th to 11th Centuries A.D. ( Provash Sen : Crafts of West Bengal ; Ahmedabad, 1994, P. 56 ) .


      কাঁথা শিল্প যে কেবল মাত্র ভারতের বাংলায় লোকশিল্পের সাথে জড়িয়ে ছিল তা নয়।  বিভিন্ন পুরাবস্তুর নিরিখে কাঁথা শিল্পের প্রমান পাওয়া যায়। হরপ্পা ও মহেঞ্জ-দাড়ো  পাওয়া পোড়ামাটির মূর্তি কিংবা সাঁচীর ভাস্কর্য যেসব পোশাক পাওয়া যায়, তাতে সুচীশিল্পকলার নিদর্শন রয়েছে। এইসব নিদর্শনের বয়স আনুমানিক খ্রিস্টপূর্বাব্দ তিন হাজার বছর থেকে খ্রিস্টাব্দ প্রথম ও দ্বিতীয় শতক। এই সময়ে একাধিক পুরাক্ষেত্রে পাওয়া পুরাবস্তুর উপাদানগুলিতে একই ধরনের শিল্প নিদর্শন পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দেখা গেছে যে - মিশর, গ্রিস, ইজরায়েল, ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশে সুচীশিল্পকলার  নিদর্শন পাওয়া যায় , যা ঐতিহ্য  অনুযায়ী বিবর্তিত হয়েছে।



তথ্যসুত্র : 
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )

Saturday, 3 October 2015

দ্বিতীয় পর্ব : কাঁথার উৎস ও ইতিহাস ( প্রথম খন্ড )


     
     লোকশিল্পের নানান বৈচিত্র্যের মধ্যে কাঁথাশিল্প এক বিশেষ ধরনের শিল্পকলা যা প্রায় হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। আবহমানকাল ধরে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সূচিশিল্পের যোগ অবিচ্ছেদ্য।  কাঁথাশিল্প সূচিশিল্পের অনন্য নিদর্শন। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে এর যোগ আদিমকাল থেকেই। বিভিন্ন পুরাবস্ত্তর নিরিখে এর প্রমান পাওয়া যায়।  


     কাঁথা শব্দটি সংস্কৃত " কন্থা " শব্দ থেকে এসেছে।  অর্থাৎ " কন্থা  -কংথা -কাঁথা "। আঞ্চলিকতার নিরিখে কাঁথা শব্দটির উচ্চারণগত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন - ক্যাঁথা, ক্যাঁতা, কেঁথা, কাঁতা, ক্যাতা, কেতা, কেথা প্রভৃতি। বাংলার মেয়েদের নিজস্ব শিল্পধারায় উচ্চারণগত নামের তারতম্য থাকলেও ব্যবহারিক উপযোগিতায় সাযুজ্য রয়েছে। 


     লোকশিল্প কলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হল রীতি বা আচার সংক্রান্ত, দ্বিতীয়টিকে ব্যবহারিক হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এবং তৃতীয়টি সমষ্টিগত শিল্প।  এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, পটুয়াদের চিত্র এবং অঙ্কন, জড়ানো পট, ঐতিহ্যময় জড়ানো পট শিল্পীদের মতো কাঁথাও বাংলার নারীদের একক সমষ্টিগত শিল্পকলার একটি উদাহরণ।বলা বাহুল্য কাঁথা গ্রামের দরিদ্রদের তথা গ্রামীন লোকায়ত সংস্কৃতির পরিচায়ক। মধ্যযুগেও কাঁথাকে দরিদ্রদের প্রধান উপকরণ হিসাবে গন্য করা হয়। বাংলার প্রায় সকল সম্প্রদায়ের মহিলাই কাঁথা তৈরী করত, এবং প্রয়োজনে উপহার হিসাবেও প্রদান করত প্রিয়জন ও নিকট আত্মীয়দের। কাঁথাশিল্প লোকশিল্পের খুবই গুরুত্বপূর্ন উদাহরণ। 

     নানা ভাবে কাঁথার বিভিন্ন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।রাজশেখর বসু তাঁর " চলন্তিকা " -এ কাঁথার অর্থ করেছেন - কতকগুলি কাপড় একত্র সেলাই করে তৈরী আস্তরণ বা শীতবস্ত্র হিসাবে। কিন্তু কাঁথা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ব্যবহারের অনুপযুক্ত বা পরিত্যক্ত কাপড়। তাই  এক্ষেত্রে কামিনী রায় তাঁর " লৌকিক শব্দকোষ "-এ কাঁথার খুবই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহনযোগ্য আভিধানিক অর্থ করেছেন। তাঁর মতে " কয়েকটি কাপড় ( সাধারনত পুরাতন ) একত্রে সেলাই করিয়া গাত্রাবরণ বা শয্যাস্তরন "। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর " বঙ্গীয় শব্দকোষ "-এ কাঁথার অর্থ করেছেন , " সেলাই করা জীর্ণবস্ত্রাদির আস্তরণ বিশেষ "। "মঙ্গলচন্ডী পাঞ্চালিক " -তে কাঁথাকে বলা হয়েছে " খাঁতা " নামে। " গোপীচন্দ্রের  গান " -এ কাঁথাকে বলা হয়েছে " ক্যাঁথা "। এছাড়া কাশীরাম দাসের " মহাভারত " ও রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের  লেখাতেও কাঁথার উল্লেখ পাওয়া যায়। 



তথ্যসুত্র : 
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )