Monday, 23 November 2015

সপ্তম পর্ব : নানান রং-এ নানা কাঁথা সামগ্রী



বিভিন্ন রূপে কাঁথা শিল্পকে ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন দ্রবাদির সৃষ্টি। যেমন শীত বস্ত্র, চাদর, ঘর সাজানোর দ্রব, জুতো, ব্যাগ, ওরনা, শাড়ি, যন্ত্রপাতির কভার, বালিশের কভার, ওয়াল-হ্যানগিং, পার্স প্রভৃতি নানাবিধ দ্রব। নানান রং-এ নানান কাঁথার সামগ্রী আজ বর্তমান। 


চেয়ারের কভার 

চাদর 


পার্স 

ব্যাগ 


         
নকশি কাঁথা 


বালিশের কভার 


শাড়ি 


লেপ

জুতো





গিলাফ 





বটুয়া 









তথ্যসুত্র : 
৩. Nakshi Kantha Images.
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )

ষষ্ঠ পর্ব : বিপণন বাজারে কাঁথা শিল্পের অবস্থান

       লোকসংস্কৃতিতে সূচিশিল্পের অনবদ্য নিদর্শন রূপে উল্লেখযোগ্য উদাহরন হল কাঁথা শিল্প। কাঁথা শিল্প এক বিশেষ ধরনের শিল্পকলা যা একান্তভাবেই বাংলার মেয়েদের। দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে কাঁথা শিল্পের যোগ অবিচ্ছেদ্য। প্রতিদিনের ব্যবহারিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে এই শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশ। শিশুর লালন পালন, বিছানার লেপ-চাদর, রুমাল, জপের মালার থলে ও নানান দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার সামগ্রীরূপে কাঁথাকে বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা হত। 

      কাঁথা শিল্প কখনই ব্যবসার উদ্দেশ্যে বিপণন শিল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনি। তবে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে  নিজেদের ব্যবহারের জন্য বা আপনজনকে উপহার দেওয়ার উদ্দেশ্যে কাঁথা সেলাই করিয়ে নেওয়ার প্রচলন ছিল। যত দিন যায় এই শিল্পের অবক্ষয় শুরু হয় । আধুনিক যন্ত্র চালিত বিভিন্ন সুচিশিল্পের ব্যবহারের প্রবনতা বাড়তে থাকে। কিন্তু কথাও যেন একটি আসার আলো আজও বর্তমান। যদিও কাঁথা শিল্প বিপণনের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠেনি তবুও কিছু মানুসের চেষ্টায় কাঁথা শিল্প আজ বিপণন শিল্পরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠান করেছে।
       মানুষের জীবনধারনের জীবকারূপে নিজের পরিচয় দিয়েছে। বুটিক শিল্পের  দুনিয়ায় এক নতুন অধ্যায় হল কাঁথা শিল্প। এবং এর সাথে যুক্ত আছে অসংখ্য কর্মচারীর যারা এই কাঁথা শিপ্লকেই জীবনধারনের জীবকারূপে গ্রহন করে এগিয়ে নিয়ে চলছে।

       বর্তমানে কেবলমাত্র বাংলার বাজারেই নয় দেশীয় বাজার এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও যথেষ্ট ভালো ভাবে প্রসার লাভ করেছে। পুরোপুরি নতুন ভাবে নতুন রূপে নিজের অস্থিত্ব প্রতিষ্ঠান করেছে। জামাকাপড় থেকে শুরু করে শীত বস্ত্র, চাদর, ঘর সাজানোর দ্রব, জুতো, ব্যাগ, ওরনা, শাড়ি, যন্ত্রপাতির কভার, বালিশের কভার, ওয়াল-হ্যানগিং, পার্স প্রভৃতি নানাবিধ দ্রবের ব্যবসায় কাঁথা শিল্প গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করছে। বানিজ্যিক বাজারে নিজের নাম প্রতিষ্ঠান করেছে। বৈদেশিক মুদ্রে অর্জনেও কাঁথা শিল্প গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করছে। 










  














তথ্যসুত্র : 
৩. Nakshi Kantha Images.
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )






  

পঞ্চম পর্ব : কাঁথাশিল্পে নকশি কাঁথা

      নকশি কাঁথা নামটি যখনই মনে আসে মনেপরে যায় "সাজু-রূপাই" এর কথা। কবি জসীমউদ্দীন-এর লেখা নকশি কাঁথার মাঠ কবিতাটি যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলার কাঁথাশিল্পে এক অবিছিন্ন অংশ হল নকশি কাঁথা। নকশি কাঁথা এ দেশের লোকশিল্পের ভুবনে উল্লেখযোগ্য শিল্প-নৈপুন্যের স্বাক্ষর। নকশি কাঁথা বাংলার নারীসমাজের হাতে তৈরী এক অনবদ্য শিল্পকলা। হাজার হাজার বছর ধরে বাংলার মেয়েরা এই অতিহ্যবাহী শিল্পের চর্চা অব্যাহত রেখেছে।
নকশি কাঁথা
      কাঁথা তৈরীর উপকরণ নিতান্তই সামান্য। সাধারণত অব্যবহার্য ও পুরনো কাপড় সেলাই করে কাঁথা তৈরী হয়। কাঁথায় বিভিন্ন মটিফ বা নকশা ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন মটিফ বা নকশার মধ্যে রয়েছে চক্র, ফুল, লতা-পাতা, পশু-পাখি, জ্যামিতিক খোপ, সংসার জীবনের চিত্র, পৌরানিক কাহিনী চিত্র প্রভৃতি। সামান্য কিছু রঙিন সুত আর সাধারন কিছু পুরনো কাপড়কে ক্যানভাস মনে করে নানান কল্পনা চিত্র কে যেন জীবন্ত করে তোলে।

       ব্যবহারিক বিভিন্নতা ও আকৃতি অনুযায়ী কাঁথার নাম ভিন্ন ভিন্ন। যেমন আসন কাঁথা, সুজনী কাঁথা, লেপ কাঁথা, শিশুর কাঁথা, চাদর কাঁথা, পালকীর কাঁথা, আর্শীলতা কাঁথা, বোচকা কাঁথা, জায়নামাজ, পান প্যাকানী, দস্তরখান, গিলাফ প্রভৃতি। নকশি কাঁথা সেলাইয়ের ক্ষেত্রে দু'টি  প্রধান ধারার প্রচলন দেখা যায়।

১) যশোরের নকশি কাঁথা। 
  ২) রাজশাহীর নকশি কাঁথা। 

       যশোর-রীতির নকশি কাঁথাতিন শ্রেনীর। যথা- চিত্রিত কাঁথা, মটিফ কাঁথা ও পাইড় কাঁথা। রাজশাহীতে সেলাই করা হয় চার ধরনের কাঁথা। যথা- লাহরী কাঁথা, কার্পেট কাঁথা, কাঁথা ও লীফ কাঁথা। যশোর অঞ্চলের কাঁথাকে শীর্ষস্থানীয় বলে ধরা হয়। যশোরের নকশি কাঁথার ফোড় অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও এতে ব্যবহৃত সুতোর রং রুচিসম্মত। 

      বহুকাল আগে থেকেই নকশি কাঁথা নিজেদের ব্যবহারের জন্য বা আপনজনকে উপহার দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরী করা হতো, বিক্রি হতো না। তবে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাঁথা সেলাই করিয়ে নেওয়ার প্রচলন ছিল। বর্তমানে শহরের কারু-বিপনীগুলোতে কাঁথা পণ্য হিসাবে ক্রয়-বিক্রয় করা হয়। এমনকি বৈদেশিক বাজারেও আজকাল নকশি কাঁথার বিপণন হচ্ছে।



নকশি কাঁথা





তথ্যসুত্র : 
৩. Nakshi Kantha Images.
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )










চতুর্থ পর্ব : কাঁথার বিভিন্ন ধরন ও ব্যবহার (তৃতীয় খন্ড)

     রুমাল কাঁথা : এই ধরনের কাঁথা চৌকো মাপের হয় অর্থাৎ এটি লম্বা ও চওড়ায় এক ফুট মাপের হয়। ছোট চারকোনা টুকরো কাপড় দিয়ে তৈরী হয় এই কাঁথা। এটি রুমাল হিসাবে ব্যবহার হলেও ডিশ ঢাকার জন্যও ব্যবহার করা হয়।  এই ধরনের কাঁথায় প্রজাপতি, পদ্ম, কলকা, ফুল, লতা-পাতা, পাখি ইত্যাদি মটিফ লক্ষ করা যায়।
রুমাল কাঁথা 

    গিলাফ : কোরান শরীফের ঢাকনা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। চৌকো নকশি কাঁথাকে বরফির মত রেখে তিন দিক একত্রিত করে সেলাই করা হয় এবং এক দিক খোলা রাখা হয়।
গিলাফ 

জায়নামাজ 
  জায়নামাজ : এইটি প্রার্থনা করার জন্য অর্থাৎ নামাজ পড়বার সময় ব্যবহার করা হয়। আকারে এইটি লম্বা ধরনের হয়। এতে ফুল, লতা-পাতা, গম্বুজ ও মিনারের মটিফ দেখা যায়।

     পান প্যাচানী : পান পেচিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। এইটির ব্যবহার নকশি থলি বা বগলির মতই।

আসন কাঁথা
     আসন কাঁথা : পুজোর কাজে এই ধরনের কাঁথা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এটি বর-কনে বা অতিথিদের বসার জন্যও ব্যবহার করা হয়। এই কাঁথার আকার চৌকো বা আয়েতকার উভয়ই হতে পারে। আবার কিছু আসন কাঁথা দেখাযায় যেগুলি একটু লম্বাটে ও বড় আকারের হয়।  পালকিতে বসার জন্যও এটি পেতে দেওয়া হয়। আবার কোনো সাধক বা পীর প্রার্থনা করার সময় এই কাঁথার ব্যবহার করেন। এতে রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, রথ ইত্যাদি মটিফ লক্ষ করা যায়। এই ধরনের কাঁথার ব্যবহৃত মটিফগুলি ধর্ম ও লোকজ বিশ্বাসবিষয়ক।

কবর বা মাজার কাঁথা 
      কবর বা মাজার কাঁথা : এই কাঁথা কবর বা মাজারের ঢাকনা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। একে আবার চাদর কাঁথাও বলা হয়। এই ধরনের কাঁথায়  নানা ধরনের নকশা চিত্রিত হয়। 

      বইতন বা বস্তানী কাঁথা : বই খাতা জড়িয়ে রাখার জন্য এই ধরনের কাঁথা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি চার হাত মাপের চতুষ্কোণ ধরনের হয়। এই ধরনের কাঁথায় মানুষ পদ্ম, কলকা, ফুল, লতা-পাতা, পাখি ইত্যাদি বিভিন্ন মটিফ লক্ষ করা যায়।

      নকশি চাদর : গায়ে দেওয়ার জন্য শাল বা চাদর হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এতে নানা ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়।  বিশেষত কলকা মটিফ এতে লক্ষ করা যায়। তবে দু-পাশের বর্ডার পাড়ের ডিজাইন এবং কোন কলকা বা মধ্যিখানে বুটির মত  ফুল বা লতা-পাতার ডিজাইন লক্ষ করা যায়। 


নকশি চাদর 
      এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কাঁথা লক্ষ করা যায়। যেমন - পাইড় কাঁথা, লাহরী কাঁথা, লীফ কাঁথা, গোলাপ বা ঢাকনি কাঁথা, পর্দা কাঁথা, সারিন্দা বা আবরণী কাঁথা প্রভৃতি। 




তথ্যসুত্র : 
৩. Nakshi Kantha Images.
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )



চতুর্থ পর্ব : কাঁথার বিভিন্ন ধরন ও ব্যবহার (দ্বিতীয় খন্ড)

আর্শিলতা
       আর্শিলতা : আর্শি, চিরুনি ও প্রসাধনসামগ্রী রাখার জন্য এই ধরনের কাঁথা ব্যবহার করা হয়। এই কাঁথা তৈরী হয় ২৪ ইঞ্চি সরু টুকরো কাপড় দিয়ে, আবার কোথাও এই কাঁথা লম্বায় এক ফুট ও চওড়ায় আধ ফুট মাপেরও হয়। এতে চাকফুল, ময়ুর, কদমগাছ, কৃষ্ণলীলা, চাঁদ-তারা ইত্যাদি মটিফের প্রাধান্য বেশি দেখা গেলেও এর মধ্যিখানে পদ্ম, কলকা বা বিভিন্ন ধরনের লতার নকশাও দেখা যায়। 


শিশুর কাঁথা
      শিশুর কাঁথা : শিশুদের শোওয়া ও গায়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় এই কাঁথা।  এই কাঁথা আকারে ছোট, অনেকটা তোয়ালের মত।  একে আবার "মুতনি" কাঁথাও বলা হয়। মাপের দিক থেকে এটি লম্বায় এবং চওড়ায় তিন ফুটের হয়।

 
 
 বর্তন ঢাকনি
   
বর্তন ঢাকনি : খাওয়ারের ঢাকনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অতিথিদের খাবারের থালার উপর ঢাকনি স্বরূপও এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার দেখা যায়। কোনো কোনো অঞ্চলে একে আবার "বেষ্টনী" বা "গাত্রী" কাঁথাও বলে।  



দস্তরখান
     দস্তরখান : অতিথিদের খাওয়ার সময় ফরাস বা পাতিতে এই কাঁথা বিছিয়ে দেওয়া হয়। আবার কখনও কখনও অতিথিদের খাওয়ার সময় সামনেও এই কাঁথা বিছিয়ে দেওয়া হয়। একে টেবিল ম্যাটও বলা যেতে পারে।


বগলি বা নকশি থলি
      বগলি বা নকশি থলি : এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার হয় বিভিন্ন ধরনের থলি হিসাবে।  এটি লম্বায় দশ ইঞ্চি এবং চওড়ায় ছয় ইঞ্চি মাপের হয়। এই ধরনের থলিতে সাধারণত টাকা-পয়সা, পান-সুপারি, জপের বা তসবির মালা রাখা হয়। একে বৈরাগীর ঝোলা বা জপের থলেও বলা হয়। এটি আকারে খামের মত বা অনেকটা ছোট বটুয়ার মত দেখতে হয়। বাংলাদেশে এর নাম "খিচা "এবং পশ্চিমবঙ্গে এটি "দুর্জনী" নামে পরিচিত।


জোত্ বা বোচকা কাঁথা
    জোত্ বা বোচকা কাঁথা : জিনিসপত্র বাঁধার জন্য এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার করা হয়। এই কাঁথায় নানান মটিফ দিয়ে ডিজাইন তোলা হয়। এই কাঁথার আকার চৌকো। কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিসপত্র যাতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে  ও বাঁধতে সুবিধা হয়। এই জন্য কাঁথা গুলি চৌকো আকৃতির হয়। 





তথ্যসুত্র : 
২. Culture of Bengal - Wikipedia, the free encyclopedia
৩. Nakshi Kantha Images.
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )

Saturday, 21 November 2015

চতুর্থ পর্ব : কাঁথার বিভিন্ন ধরন ও ব্যবহার (প্রথম খন্ড)

       বাংলার কাঁথা শিল্প মহিলাকুলের কল্পনা ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে, শুধু  তাই নয় তাদের প্রিয় জনের প্রতি কমল হৃদয়বৃত্তি ও ভালোবাসা প্রকাশ করে। গ্রামাঞ্চলের নারীরা পাতলা কাপড়, প্রধানত পুরানো নানান রঙ এর কাপড়কে স্তরে স্তরে সাজিয়ে সাজিয়ে নানান রঙ এর সুত দিয়ে  সেলাই করে কাঁথা তৈরী করে থাকতেন। কাঁথা মিতব্যয়িতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে একাধিক পুরানো জিনিস একত্রিত করে একটি প্রয়োজনীয় নুন জিনিস তৈরী করা হয়।কাঁথার প্রাথমিক ব্যবহার ছিল এবং এখনও যা আছে তা হল শরীরকে গরম রাখা ও ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা করা। ব্যবহার ও আকার অনুযায়ী কাঁথা কে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।   

      সুজনি কাঁথা : অতিথিদের বসা বা শোওয়ার জন্য বিছানায় বিছিয়ে দেওয়া হয়।  এই কাঁথার দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় ফুট এবং প্রস্ত প্রায় সাড়ে তিন ফুট হয়। এই কাঁথা আকারে বড় বলে এর কেন্দ্রবিন্দুতে পদ্মের মটিফ যেমন থাকে, তেমন পাড়ের ডিজাইন, কলকা, নানান লতা-পাতার ডিজাইনের বাহারও দেখা যায়। ঝিকরগাছায় এই কাঁথার নাম "নাছ্নি কাঁথা "। এই কাঁথায় ফুলের নকশা তোলা হয় পার্সিয়ান প্রভাবে। 
সুজনি কাঁথা

লেপ কাঁথা
লেপ কাঁথা : শীতের সময় গায়ে দেয়ার জন্য বেশ মোটা ধরনের কাঁথা। মাপেও এটি সুজনি কাঁথার চেয়ে লম্বা ও চওড়ায় কিছুটা বড়। এতেও নানা ধরনের নকশা তোলা হয়, তবে সুজনির তুলনায় কম।

     
ব্যটন বা ওয়াড় কাঁথা

ব্যটন বা ওয়াড় কাঁথা : বালিশের ঢাকনা হিসাবে ব্যবহার করা হয় এই ধরনের কাঁথা।  এই কাঁথার সাধরন মাপ হলো লম্বায় প্রায় দু-ফুট আর চওড়ায় প্রায় দের ফুট। এর দু-পাশে নানান লতা-পাতার ডিজাইন  কিংবা কোনো কলকার ডিজাইন বা অন্য কোনো ডিজাইন দেওয়া হয়। আবার লেপের ঢাকনা হিসেবেও এই কাঁথার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তবে সে ক্ষেতে লেপের ওয়াড় কাঁথা মাপে অনেক বড় হয়। এই কাঁথাকে আবার ব্যটন কাঁথাও বলা হয়। "বেষ্টনী" শব্দের অপভ্রংশ থেকেই বোধহয় "ব্যটন" শব্দটি এসেছে। 





তথ্যসুত্র : 
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )

Tuesday, 17 November 2015

তৃতীয় পর্ব : কাঁথা শিল্পের ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ


অবিভক্ত বাংলা
      ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ  অনুযায়ী  দেখতে গেলে অবিভক্ত বাংলা জুড়েই কাঁথা শিল্পের প্রসার ঘটেছিল। প্রকৃত অর্থে কাঁথা শিল্প হল বঙ্গনারীর শিল্পকলা। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাকৃতিক এবং রাজনৈতিক ভুখন্ডের অন্তর্গত পর্বত ও তার পাদদেশ, মালভূমি, উপত্যকা, সমভূমি ব-দ্বীপ এবং অন্যান্য ভূমি গঠনের মধ্যে বাংলার সংস্কৃতি, এর কলা, নিজভাষা ও ধর্ম এবং গ্রন্থের প্রভাব অনুভব করা যায়। প্রাকৃতিক কারন বাংলায় বিভিন্ন শিল্পকলার জন্ম দিয়েছে। লোকশিল্পকলা হচ্ছে সাধারন ভাবে দেশের গ্রামীন মানুষের আশা এবং আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। সাধারন ভাবে এই শিল্প দেশের মৃত্তিকায় গভীর ভাবে প্রোথিত এবং জনপ্রিয় বিশ্বাস ও রীতির সঙ্গে খুব নিবিড় ভাবে জড়িত। বাংলার ঐতিহ্যশালী শিল্প রূপে নিজেকে প্রকাশ করেছিল।

বিভক্ত  বাংলাদেশ 
          স্বাধীনতার পূর্ব অবিভক্ত বাংলায় কাঁথা শিল্পের যে প্রসার ঘটেছিল তা স্বাধীনতার পর বাংলার বিভক্ত হওয়ায় নানান দিক থেকে প্রভাবিত হয়েছে। পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, যশোর, পুঠ্লা, নবাবগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, বরিশাল, মধুপুর প্রভৃতি অঞ্চলে  কাঁথা শিল্পের প্রসার ঘটে।

পশ্চিম বঙ্গ
          অপরদিকে ভারতের অন্তর্গত পশ্চিম বঙ্গের বীরভূমের বোলপুর অঞ্চল, পুরুলিয়া, নদীয়ার কৃষ্ণনগর অঞ্চল বসিরহাটের সেনপালা অঞ্চল, বারাসাত, কদম্বগাছি প্রভৃতি অঞ্চলে কাঁথা শিল্পের বিস্তার লক্ষ করা যায়। বর্তমানে পরিশীলিত ও অশীলিত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঐতিহ্যশালী শিল্পকলা এক অবক্ষয়ের পর্যায়ের মধে প্রবেশ করেছে। লোকশিল্প উপযুক্ত এবং সমবেদনাপুর্ন গ্রামীন শিল্পীর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংস প্রাপ্ত  হয়ে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। 




তথ্যসুত্র : 
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )

Wednesday, 28 October 2015

দ্বিতীয় পর্ব : কাঁথার উৎস ও ইতিহাস ( দ্বিতীয় খন্ড )

     বাংলার  কাঁথা শিল্প এক সুপ্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সুচিশিল্পের যোগ আদিমকাল থেকেই লক্ষ করা যায়। এই শিল্প প্রাচীন ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শিল্প হয়ে উঠেছিল।  

    কাঁথার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋক্ বেদ ও উপনিষদ তথা বৌদ্ধ পালি সাহিত্যে। মহাভারতের শান্তি পর্বে উল্লিখিত আছে - '' জীর্ণা কন্থা ততঃ কিম় " (শান্তি ৪। ৫। ১৯) । চন্দ্রাবতীর রামায়নে সীতার দক্ষতা বা গুন প্রসঙ্গে কন্থার কাজের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এমনকি কবি ভারতচন্দ্রের লেখনীতেও কাঁথার উল্লেখ রয়েছে। শিবের উপস্থাপনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন - "ঝুলি কাঁথা বাঘ ছাল সাপ সিদ্ধি লাড্ডু "। মেগাস্থিনিসের '' ভারত বৃত্তান্ত " এবং পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে কাঁথা উল্লেখ লক্ষ করা যায়। এ ছাড়াও আরও একাধিক বইতে কাঁথার উল্লেখ পাওয়া যায়। 


     বহু প্রাচীনকাল  থেকে জীর্ণ বস্ত্রখন্ডে তৈরী কাঁথার ব্যবহার শুরু হলেও কাঁথার গায়ে বিচিত্র নকশা খচিত করার রেওয়াজ কবে প্রচলিত হয় তা সঠিকভাবে বলা যায় না। কাঁথার সংগ্রহ রয়েছে বিভিন্ন সংগ্রহশালায়। এইসব কাঁথার বয়স খুব বেশি পুরোনো নয়। স্টেলা আরিখের রচনায় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের  কাঁথার সন্ধান পাওয়া যায় ( Marg III, No. 2, P. 20 )। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রভাস সেন কাঁথার প্রাচীনতা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা হল : - 

    The tradition of kantha embroidery is very old. It is mentioned in the definitive Sanskrit grammar written by Panini  around the six century B.C. and also in the epic Ramayana of Valmiki about two centuries later. The earliest mention of kanthas in Bengali literature is found in the Charyapadas- the earliest known in as old form of Bengali that prevailed from the 8th to 11th Centuries A.D. ( Provash Sen : Crafts of West Bengal ; Ahmedabad, 1994, P. 56 ) .


      কাঁথা শিল্প যে কেবল মাত্র ভারতের বাংলায় লোকশিল্পের সাথে জড়িয়ে ছিল তা নয়।  বিভিন্ন পুরাবস্তুর নিরিখে কাঁথা শিল্পের প্রমান পাওয়া যায়। হরপ্পা ও মহেঞ্জ-দাড়ো  পাওয়া পোড়ামাটির মূর্তি কিংবা সাঁচীর ভাস্কর্য যেসব পোশাক পাওয়া যায়, তাতে সুচীশিল্পকলার নিদর্শন রয়েছে। এইসব নিদর্শনের বয়স আনুমানিক খ্রিস্টপূর্বাব্দ তিন হাজার বছর থেকে খ্রিস্টাব্দ প্রথম ও দ্বিতীয় শতক। এই সময়ে একাধিক পুরাক্ষেত্রে পাওয়া পুরাবস্তুর উপাদানগুলিতে একই ধরনের শিল্প নিদর্শন পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দেখা গেছে যে - মিশর, গ্রিস, ইজরায়েল, ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশে সুচীশিল্পকলার  নিদর্শন পাওয়া যায় , যা ঐতিহ্য  অনুযায়ী বিবর্তিত হয়েছে।



তথ্যসুত্র : 
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )

Saturday, 3 October 2015

দ্বিতীয় পর্ব : কাঁথার উৎস ও ইতিহাস ( প্রথম খন্ড )


     
     লোকশিল্পের নানান বৈচিত্র্যের মধ্যে কাঁথাশিল্প এক বিশেষ ধরনের শিল্পকলা যা প্রায় হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। আবহমানকাল ধরে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সূচিশিল্পের যোগ অবিচ্ছেদ্য।  কাঁথাশিল্প সূচিশিল্পের অনন্য নিদর্শন। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে এর যোগ আদিমকাল থেকেই। বিভিন্ন পুরাবস্ত্তর নিরিখে এর প্রমান পাওয়া যায়।  


     কাঁথা শব্দটি সংস্কৃত " কন্থা " শব্দ থেকে এসেছে।  অর্থাৎ " কন্থা  -কংথা -কাঁথা "। আঞ্চলিকতার নিরিখে কাঁথা শব্দটির উচ্চারণগত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন - ক্যাঁথা, ক্যাঁতা, কেঁথা, কাঁতা, ক্যাতা, কেতা, কেথা প্রভৃতি। বাংলার মেয়েদের নিজস্ব শিল্পধারায় উচ্চারণগত নামের তারতম্য থাকলেও ব্যবহারিক উপযোগিতায় সাযুজ্য রয়েছে। 


     লোকশিল্প কলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হল রীতি বা আচার সংক্রান্ত, দ্বিতীয়টিকে ব্যবহারিক হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এবং তৃতীয়টি সমষ্টিগত শিল্প।  এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, পটুয়াদের চিত্র এবং অঙ্কন, জড়ানো পট, ঐতিহ্যময় জড়ানো পট শিল্পীদের মতো কাঁথাও বাংলার নারীদের একক সমষ্টিগত শিল্পকলার একটি উদাহরণ।বলা বাহুল্য কাঁথা গ্রামের দরিদ্রদের তথা গ্রামীন লোকায়ত সংস্কৃতির পরিচায়ক। মধ্যযুগেও কাঁথাকে দরিদ্রদের প্রধান উপকরণ হিসাবে গন্য করা হয়। বাংলার প্রায় সকল সম্প্রদায়ের মহিলাই কাঁথা তৈরী করত, এবং প্রয়োজনে উপহার হিসাবেও প্রদান করত প্রিয়জন ও নিকট আত্মীয়দের। কাঁথাশিল্প লোকশিল্পের খুবই গুরুত্বপূর্ন উদাহরণ। 

     নানা ভাবে কাঁথার বিভিন্ন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।রাজশেখর বসু তাঁর " চলন্তিকা " -এ কাঁথার অর্থ করেছেন - কতকগুলি কাপড় একত্র সেলাই করে তৈরী আস্তরণ বা শীতবস্ত্র হিসাবে। কিন্তু কাঁথা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ব্যবহারের অনুপযুক্ত বা পরিত্যক্ত কাপড়। তাই  এক্ষেত্রে কামিনী রায় তাঁর " লৌকিক শব্দকোষ "-এ কাঁথার খুবই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহনযোগ্য আভিধানিক অর্থ করেছেন। তাঁর মতে " কয়েকটি কাপড় ( সাধারনত পুরাতন ) একত্রে সেলাই করিয়া গাত্রাবরণ বা শয্যাস্তরন "। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর " বঙ্গীয় শব্দকোষ "-এ কাঁথার অর্থ করেছেন , " সেলাই করা জীর্ণবস্ত্রাদির আস্তরণ বিশেষ "। "মঙ্গলচন্ডী পাঞ্চালিক " -তে কাঁথাকে বলা হয়েছে " খাঁতা " নামে। " গোপীচন্দ্রের  গান " -এ কাঁথাকে বলা হয়েছে " ক্যাঁথা "। এছাড়া কাশীরাম দাসের " মহাভারত " ও রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের  লেখাতেও কাঁথার উল্লেখ পাওয়া যায়। 



তথ্যসুত্র : 
৪. লোকশ্রুতি ( তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর )
৫. লোকজ শিল্প (বরুণকুমার চক্রবর্তী )

Saturday, 19 September 2015

প্রথম পর্ব : লোকশিল্প রূপে বাংলার কাঁথা

   

      লোক সংস্কৃতি হল লোক সমাজের একটি ধারা যা সভ্যতার প্রথম যুগ থেকে অবিছিন্ন গতীতে চলে আসছে। নানা দেশের নানান মানুষ আর এই মানুষের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায় যুগ যুগ ধরে চলে আসা নানা সংস্কৃতি।  সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায়, লোক সংস্কৃতি তারই একটি অংশ।  " লোক সংস্কৃতি " কথাটি লক্ষ্য করলে সহজেই বোঝা যায় " লোক " অর্থাৎ "মানুষ ", মানুষের সংস্কৃতিই হল লোক সংস্কৃতি। 
         
      লোক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে - লোক কথা, লোক সংগীত, লোক নৃত্য, লোক চিত্র, লোক নাট্য, লোক শিল্প প্রভৃতির সংমিশ্রনে। এই সব কিছু মিলেই হল লোক সংস্কৃতি। বিভিন্ন সংস্কৃতি, লোক সংস্কৃতির সংমিশ্রনে গড়ে ওঠা আমাদের দেশ হল ভারতবর্ষ, আর বাংলার লোক সংস্কৃতি হল ভারতীয়  লোক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। 

      বিভিন্ন লোক সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ বাংলার একটি অতি জনপ্রিয়  লোক শিল্প হল " বাংলার কাঁথা " শিল্প। বাংলার নারী সমাজের হাতে তৈরী এক অনবদ্য শিল্পকলা। কখনো পুরান কথা, কখনো বা প্রকৃতি আবার কখনো বা জীবনী চোখের সামনে সুতোর কাজে ফুটিয়ে তুলছে যুগ যুগ ধরে। প্রেমের কথা, সোহাগের কথা সবই তুলে ধরা হয় এই হাতের কাজে। 

     গ্রাম বাংলার এই ঘরের শিল্প আজ ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ নেই, ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে শুধু বাংলায় নয় দেশ বিদেশে নিজের অস্তিত্বের পরিচয় দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের নাম লিখিয়েছে, একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে। বহু মানুষের জীবন ধরনের উপায় অর্থাৎ উপার্জনের পথ হয়ে উঠেছে।  বাংলার এই  লোক সংস্কৃতি যে শুধু দেশ বিদেশে তথা আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছে তা নয় নিজের অস্তিত্ব যাতে বজায় থাকে তার প্রচেষ্টাও চালিয়ে চলেছে।



তথ্যসুত্র : 
. Nakshi Kantha Images.